রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

নির্মূলের মুখে মিয়ানমারের মুসলমান


ফিরোজ মাহবুব কামাল

মিয়ানমারের মুসলমানেরা আজ ভয়ানক বিপদের মুখে। তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশ, সৈন্যরা লাশগুলোকে দাফন করতে না দিয়ে গায়েব করে দিচ্ছে। এশিয়ান করেসপন্ডেন্ট ডট কমের সাংবাদিক ফ্রান্সিস ওয়াদের রিপোর্ট, পুলিশ দাঙ্গাকারি বার্মিজদের সাথে মিলে মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। পুলিশ মুসলমানদের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়ছে। এমনও রিপোর্ট আসছে, নিহত ও আহত মুসলমানদের মাথা মুড়িয়ে ও গায়ে গেরুয়া পোশাক পরিয়ে ছবি তুলে বৌদ্ধ বলে বিশ্বময় প্রচার চালাচ্ছে। সমুদ্রে নামা ছাড়া মুসলমানদের সামনে আশ্রয় লাভের কোন স্থান নেই। বাংলাদেশই একমাত্র প্রতিবেশী মুসলিম দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে আসাও তাদের জন্য অসম্ভব করা হয়েছে। আহত ও ক্ষুধার্ত নারী-শিশুদের নিয়ে তাদের নৌকাগুলো দিবারাত্র সাগরে ভাসছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য এ এক নিদারুণ দুরবস্থা।
ঘরবাড়ি আগুনে বিধ্বস্ত হলে পাশের প্রতিবেশী আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে। তেমনি কোন দেশে একটি জনগোষ্ঠি নির্মূলের মুখে পড়লে প্রতিবেশী দেশ এগিয়ে আসে। কিন্তু পাশে সমুদ্র ছাড়া মিয়ানমারের মুসলমানদের সে রকম প্রতিবেশী নেই। তাদের দুর্ভাগ্য, তারা প্রতিবেশী রূপে পেয়েছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানে যখন সোভিয়েত আগ্রাসন শুরু হয়ে তখন তিরিশ লাখ আফগান নাগরিক তিরিশ বছর যাবত পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০ লাখ আশ্রয় নিয়েছিল ইরানে। সাতচল্লিশে লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমানগণ জানমাল বাঁচাতে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। একইভাবে ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ ফিলিস্তিনী প্রতিবেশী আরব দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি সিরিয়ার হাজার হাজার নাগরিক আশ্রয় নিচ্ছে পাশ্ববর্তী তুরস্ক, জর্দান ও লেবাননে। ইতিহাসে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। অসহায় উদ্বাস্তুদের প্রবেশ রুখতে কোন প্রতিবেশী দেশই দরজা বন্ধ করে দেয় না। মিয়ানমারের মুসলমানেরা প্রতিবেশী থেকে সেরূপ আচরণ পায়নি।  
বাংলাদেশের নতুন রেকর্ড
বাংলাদেশ অতীতে ৫ বার রেকর্ড করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশ রূপে। এবার আরেক রেকর্ড যোগ হলো। সেটি হৃদয়হীনতার। প্রতিবেশী রূপে বাংলাদেশ যে কতটা খারাপ সেটিই বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করলো। মিয়ানমারের মুসলমানদের এটি এক বড় দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী, কোস্টাল গার্ড ও পুলিশ বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানভর্তি নৌকাগুলোকে বাংলাদেশের সীমান্তে ভিড়তে দিচ্ছে না। সীমান্তরক্ষিরা তাদের পুশব্যাক করছে। কক্সবাজারের ১৭ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান পিএসসি বলেন, সীমান্ত ও উপকূলীয় এলাকায় বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। গতকাল সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেনি। নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ১৫ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব বলেন, পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। সীমান্ত এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। -(সূত্রঃ নয়াদিগন্ত, ১৪/০৬/১২)। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়াই যে সরকারি নীতি এ হলো তার প্রমাণ। অথচ আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক বাংলাদেশ দায়বদ্ধ এমন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া। জান বাঁচানোর স্বার্থে কেউ যদি অন্য দেশে প্রবেশ করে তবে কোন সভ্যদেশেই তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি বলে না। জানা বাঁচানো প্রতিটি নাগরিকেরই মৌলিক মানবিক অধিকার। সেটি কোন দেশে বিপন্ন হলে সে অন্য যে কোন দেশে আশ্রয় নেয়ার অধিকার রাখে। সেটিই আন্তর্জাতিক নীতি।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে সরকারের প্রতি ইতিমধ্যে আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি আবারও সে দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। সরকারের অনড় অবস্থানের ফলেই গতকাল ১১৪ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়নি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। (সূত্রঃ আমার দেশ, ১৪/০৬/১২)। এভাবে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ সরকার জানিয়ে দিল, দেশটি শুধু হাত পেতে ত্রাণ নিতেই জানে, দিতে নয়। তারা শুধু দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার সামর্থই রাখে না, বিপদে পড়া প্রতিবেশীদের প্রতি অতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর হওয়ারও সামর্থ রাখে। একটি জনগোষ্ঠির বিবেকের পচন আর কত কাল এভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে?
লক্ষণীয় হলো, নির্দয়তা শুধু সরকারের একার নয়। বরং আক্রান্ত যেন সমগ্র দেশ। মুসলিম উৎখাতের ন্যায় নিষ্ঠুরতা থামাতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলে যেমন কোন উদ্যোগ নেই, তেমনি সে মুসলিম-নির্মূল নীতির বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায়ও কোন প্রতিবাদ নাই। বাংলাদেশ সরকারের মানবতাশূন্য নীতির বিরুদ্ধে দেশের বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী, লেখক-বুদ্ধিজীবী, ছাত্রশিক্ষক ও আলেম-উলামাদের পক্ষ থেকেও কোন নিন্দাবাদ নাই। মিয়ানমারের মুসলিম-নির্মূলে বিষয়টি নতুন নয়। আশির ও নববইয়ের দশকের শুরুতে একই রূপ নির্মূল অভিযান শুরু হয়েছিল। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তখন দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদের বহু হাজার মুসলমান  এখন বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়ে আছে।
দেশহীন থেকে গৃহহীন
আরাকানের মুসলমানদের সাথে বড়ই অবিচার হলো তারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও তাদের সে দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এর চেয়ে বড় অবিচার আর কি হতে পারে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে মাত্র ৫ বছর বৈধ বসবাসের সার্টিফিকেট দেখাতে পারলে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। অথচ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের শত শত বছর ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে বসতি স্থাপনকারিগণ যত বছর ধরে বসবাস করছে তার চেয়ে বেশী বছর যাবত আরাকানে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। অথচ তাদের নাগরিত্ব না দিয়ে এখন বহিস্কারের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। নাগরিকতা দেয়া হয়নি নিছক ধর্মীয় কারণে। আর এখন তাদের গৃহহীন করা হচ্ছে।
প্রতিদেশেই নানা ধর্ম, নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষ দিয়ে গড়ে উঠে। বাংলাদেশে যেমন মুসলমানের পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান আছে তেমনি বাংলাভাষীদের পাশে বহু অবাঙালীও আছে। বহু চাকমা, গারো, হাজং, মুনিপুরি, মগও আছে। শুধু এক ধর্ম, এক ভাষা ও এক বর্ণের মানুষ দিয়ে দেশ গড়ার প্রেরণাটি অতি অসুস্থ চেতনার। সে অসুস্থ চেতনার মানুষেরা ভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষদের নির্মূল করার ন্যায় ভয়ানক অপরাধটি ঘটায়। জার্মানীতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে সেটিই ঘটেছিল। তেমনটি ঘটেছে ইসরাইল ও বসনিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আজ একই অপরাধ ঘটছে মিয়ানমারে। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থেকে ভিন্নতর ধর্ম ও ভাষা হওয়ার কারণেই কারো নাগরিকত্ব হরণ করা যায় না। অথচ মিয়ানমারে সেটিই হয়েছে। এমনটি হয়েছে মুসলিম ভীতি থেকে। মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরনের কারণ রূপে দেখানো হচ্ছে তারা এসেছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ থেকে। কথা হলো তারা যদি বাংলাদেশ থেকে গিয়েও থাকে সেজন্য কি তাদের নাগিরকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায়? নানা দেশে বিচিত্র মানুষের যে সংমিশ্রণ দেখা যায় তার কারণ এ নয় যে মানুষগুলো আসমান থেকে নাযিল হয়েছে। বরং আসে পার্শ্ববর্তি দেশ থেকে। বাংলাদেশে বহু মানুষ ভারত থেকে এসে বসতি গড়েছে, সেটি যেমন শত শত বছর আগে, তেমনি অনেকের আগমনের বয়স ৬৫ বছরের বেশি নয়। তেমনি বহু মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েও বসবাস করছে। মানুষ যেমন জন্ম নেয়, তেমনি মাইগ্রেশনও করে। সেটিই সভ্যতার রীতি। হাজার হাজার বছর ধরে সে রীতি চলে আসছে। কিন্তু সে মাইগ্রেশনের জন্য কি কারো নাগিরত্ব হরন করা যায়? অথচ সে নিদারুণ অবিচার হচ্ছে মিয়ানমারের মুসলমানদের সাথে। 
মুসলিম বসতি হাজার বছরের
আরাকানে মুসলমানদের বসতি হাজার বছরেরও বেশী পুরোন তার পিছনে দলিল রয়েছে। সে দলিল রয়েছে খোদ মিয়ানমারে। সেখানে মুসলমান বসতির সূত্রপাত প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক আরাকানের জাতীয় ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘রাজোয়াং' থেকে নিম্নোক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেনঃ ‘‘খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ পাদে যখন আরাকান রাজ মহতৈং চন্দয় (Mahatoing Tsandya-788-810 A. D) রাজত্ব করিতেছিলেন, তখন কতকগুলি মুসলমান বনিক জাহাজ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ফলে আরাকানের দক্ষিণ দিকস্থ ‘রনবী' (আধুনিক রামরী) দ্বীপে উঠিয়া পড়েন।তাঁহারা আরাকানীগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া রাজার সম্মুখে নীত হয়েছিলেন।রাজা তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া দয়া পরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় রাজ্যে গ্রামে গিয়া বসবাস করিতে আদেশ দিয়াছিলেন।’’ ডঃ এনামুল হক মনে করেন যে, ‘‘রাজোয়াং এ উল্লেখিত এ সব মুসলমান বণিক আরব দেশীয় ছিলেন এবং চাঁটগা থেকে উপকূল বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার পথে, কিংবা দক্ষিন উপকূল হয়ে উত্তরে চাটগাঁর দিকে এগুবার সময়ই ঝঞ্জাতাড়িত হয়ে সম্ভবতঃ তাঁরা রামরী দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।’’ সুপ্রাচীন আরবীয় ঐতিহ্য অনুসারে একই সাথে জীবিকা অর্জন ও ধর্ম প্রচারের সুমহান চেতনায় উদ্ধৃদ্ধ হয়ে মুসলমানেরা দলে দলে নৌ ও স্থলপথে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সমুহে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরই অংশ হিসেবে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে বার্মায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে উঠে। জীবন-জীবিকার অনিবার্য প্রয়োজনে স্থানীয় মহিলাদেরকে বিবাহ-শাদী করে তাঁরা সেখানে ধনে-জনে বর্ধিত হতে থাকে।  
পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশের মুসলমান
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ ভয়ানক বিপদে বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর বিশাল দায়ভার। আল্লাহতায়ালা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন।কখনো তার নিজের উপর বিপদ দিয়ে, আবার কখনো প্রতিবেশীর উপর বিপদ দিয়ে। বাংলাদেশের মুসলমানগণ তাই এখানে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এ পরীক্ষায় ফেল করলে শুধু মানব জাতির ইতিহাসেই তাদের কদর্যতা বাড়বে না, আল্লাহর দরবারেও তাদের ব্যর্থতা বাড়াবে। প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে প্রতিবেশী মাত্রই সর্ব সামর্থ নিয়ে সে আগুন থামানোর চেষ্টা করে। প্রতিবেশীর মাঝে সে তাড়না না থাকলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তিটি অমানুষ। জন্তু-জানোয়ার ও উদ্ভিদের সে সামর্থ থাকে না বলেই তারা ইতর। প্রতিবেশী-সুলভ এমন কাজের জন্য মুসলমান হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। এমনকি অমুসলিম কাফেরগণও সে কাজ করে। তবে মুসলমানদের উপর সে পরীক্ষাটি আরো বেশী বেশী আসে। কারণ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতে মৃত্যুহীন এক অনন্ত জীবন দেয়ার আগে আল্লাহতায়ালা তাদের যাচাই বাছাই করে নেন। তাই সে চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলি আসে সে যাচাই বাছাইয়ের অপরিহার্য অংশ রূপে। সে পরীক্ষায় পাশ করার তাগিদে মুসলমান তাই শুধু প্রতিবেশীর ঘরের আগুন নেভাতে ছুটে যায় না, তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতেও সচেষ্ট হয়।
মুসলমানদের সাথে সে ভ্রাতৃত্বের সে বন্ধন গড়তে হয় ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে। তাই আরবের আলী (রাঃ) ও উমর (রাঃ), ইথিওপিয়ার বেলাল (রাঃ), পারস্যের সালমান (রাঃ) এবং গ্রীকের সোহায়েল (রাঃ) সে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এমন মুসলমানদের নিয়েই আল্লাহপাক গর্ব করেন; ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার গর্বে ভেসে যাওয়া বর্ণবাদীদের নিয়ে নয়। তাই শুধু মসজিদ মাদরাসা বাড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া যায় না, একক উম্মতের চেতনায় ভ্রাতৃত্বও গড়ে তুলতে হয়। সে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে খেলাফতও গড়তে হয়। নইলে আজ যে বিপদ আরাকানের মুসলমানদের উপর নেমে আসছে সেটি বাংলাদেশের মুসলমানদের উপরও একদিন নেমে আসতে পারে।
মিয়ানামারের রোহিঙ্গাদের বিপদে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বাঙালী জাতিয়তাবাদীদের চেতনায় কোনরূপ দুঃখ নেই। ভারতীয় নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছিলেন, কোন তুর্কি সৈনিকের পায়ে যদি কাঁটা বিদ্ধ হয় আর সে কাঁটার ব্যথা যদি তুমি হৃদয়ে অনুভব না করো তবে খোদার কসম তুমি মুসলমান নও। -(মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রচনাবলি, ইসলামী ফাউন্ডেশন)। মাওলানা আযাদ যে সময় এমন কথা লিখেছিলেন তখন খেলাফত বাঁচাতে তুর্কি  সৈনিকেরা শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড লড়াই লড়ছিল। 
কিন্তু রোহিঙ্গাদের পায়ে আজ কাঁটা বিঁধছে না, বরং গুলীবিদ্ধ হচ্ছে তাদের দেহে। এবং ভস্মীভূত হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ী-দোকানপাট। তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের নিজ দেশ থেকে। সে গুলির বেদনা এবং সে ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হওয়ার দুঃখ কি বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা অনুভব করেন? যাদের মধ্যে সে বেদনা নাই তাদের কি মুসলমান বলা যায়? বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, আরাকানে মুসলিম নিধন করা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীন বিষয়।তিনি আরো বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ ঠিক হবে না। দায়িত্বহীনতা আর কাকে বলে? অথচ আন্তর্জাতিক নীতি হলো, যখন কোন জনগোষ্টির বিরুদ্ধে নির্মূল প্রক্রিয়া চলে তখন সেটি আর সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। সেটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়। এমন প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো দায়িত্বশীলতা, সেটি যেমন আল্লাহর প্রতি তেমনি প্রতিবেশী মুসলমানদের প্রতি। বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে সে প্রতিবেশী হলো রোহিঙ্গা মুসলিম। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ কি তেমন দায়িত্বশীল রূপে নিজেদের পরিচয়টি দিতে পারছে?

রবিবার, ৬ মে, ২০১২

সাংস্কৃতিক হামলা ও বিপন্ন স্বাধীনতা




ফিরোজ মাহবুব কামাল
বিপন্ন স্বাধীনতা : প্রতি দেশে ভৌগোলিক মানচিত্রের সাথে একটি আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক মানচিত্রও থাকে। আদর্শিক বা সাংস্কৃতিক মানচিত্রটি গড়ে উঠে দেশবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা এবং সংস্কৃতির ভিত্তিতে। ভৌগোলিক মানচিত্রের স্থায়িত্বের জন্য আদর্শিক মানচিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আদর্শিক মানচিত্র থেকেই নির্ধারিত হয় ভৌগোলিক মানচিত্রের সীমারেখা। এটি দুর্বল হলে দেশের ভূগোল বাঁচে না। ভূগোলের অখন্ডতা বাঁচাতে যেটি সিমেন্টের ন্যায় কাজ করে সেটি ভূমি, জলবায়ু বা আলো-বাতাস নয়, বরং জনগণের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি। দেশের অখন্ড ভৌগোলিক মানচিত্র ভেঙ্গে যায়, আবার বিচ্ছিন্ন বহু ভূখন্ড, বহু গোত্র ও বহু জনগোষ্ঠী একীভূত হয় সে আদর্শিক মানচিত্রের কারণে। ইসলামের পূর্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য খন্ডিত ছিল নানা ভাষা ও নানা গোত্রের নামে। কিন্তু সে বিভক্ত মানচিত্রকে একীভূত করে সে ভূমিতে গড়ে উঠেছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তি। আরব, কুর্দি, ইরানী, তুর্কি তখন এক উম্মাহতে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদ, গোত্রীয়বাদ ও রাজতন্ত্রের হামলায় সে আদর্শিক মানচিত্র বাঁচেনি। ফলে বাঁচেনি সে বিশাল ভৌগোলিক মানচিত্রও। একই কারণে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের ভূগোলও অখন্ড থাকেনি, সেটি ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান এ দু'টি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল। আবহমান বাংলার ভৌগোলিক মানচিত্র এক হলেও তার আদর্শিক মানচিত্রটি দ্বিখন্ডিত। ফলে বাংলাও খন্ডিত হয়েছে; একটি হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলায়, অপরটি মুসলিমপ্রধান পূর্ব বাংলায়। একাত্তরে পাকিস্তান খন্ডিত হয়েছে, কিন্তু পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা একীভূত হয়নি এবং পূর্ব পাকিস্তান ভরতে মিশে যায়নি। সেটি হয়নি আদর্শিক ও ধর্মীয় বিভক্তির কারণে।
শত্রুর হামলা শুধু ভৌগোলিক মানচিত্রের উপর হয় না, প্রচন্ড হামলা হয় আদর্শিক মানচিত্রের উপরও। আদর্শিক মানচিত্রের উপর হামলাটি নীরবে হয়, সেখানে বোমা বা কামানের গর্জন থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র ধ্বংসে এটি সীমান্ত হামলার ন্যায়ই সমান ক্ষতিকর। এটিকে বলা যায় ঠান্ডা যুদ্ধ। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে প্রায় ত্রিশটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে এরূপ আদর্শিক হামলার কারণে। এ হামলায় শত্রুর সৈনিক রূপে কাজ করেছে সেক্যুলারিস্ট ও জাতীয়তাবাদীরা। যে কোনো দেশের সরকার ও জনগণের দায়িত্ব হলো ভৌগোলিক ও আদর্শিক-এ উভয় মানচিত্রকে হেফাজত করা। নইলে স্বাধীনতা বাঁচে না। কারণ, একটি অপরটির পরিপূরক; ভৌগোলিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে যেমন আদর্শিক মানচিত্র থাকে না। তেমনি আদর্শিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে ভৌগোলিক মানচিত্রও বাঁচে না। তাই শুধু সেনাবাহিনী দিয়ে দেশে বাঁচানো যায় না। লড়াকু আদর্শিক সৈনিকও চাই। সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল কোনো সশস্ত্র যুদ্ধে নয়। বরং বিপুল সংখ্যক আদর্শিক সৈনিকের লাগাতর লড়াইয়ের কারণে, পাকিস্তানের পক্ষে তুমূল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটি সে সময়ের ইসলামী চিন্তানায়করা অতি সফলভাবে লড়েছিলেন। আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মহম্মদ আলী জওহরের ন্যায় বহু লড়াকু চিন্তানায়কগণ সেদিন সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী প্যান-ইসলামিক চেতনা প্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন। সে প্লাবনে বাঙালি, পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, বেলুচ, সিন্ধি প্রভৃতি ভাষাভাষী মুসলমান ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা ভুলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু ১৯৭১-এ সেরূপ সৈনিক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না, বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানটি তখন অধিকৃত হয়েছিল ইসলামে অঙ্গীকারশূন্য জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদীদের হাতে। একাত্তরের বহু আগেই এ ময়দান ভারত নীরবে দখল করে নিয়েছিল। বহু হাজার সাংস্কৃতিক সৈনিকের সমাবেশ ঘটিয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই এবং তারা বিনাশ ঘটিয়েছিল প্যান-ইসলামিক চেতনার। ফলে ১৯৪৭-এর পাকিস্তানও একাত্তরে বাঁচেনি। একই বিপদ ঘিরে ধরেছে একাত্তরের সৃষ্ট বাংলাদেশকেও।
তবে বাংলাদেশের বিপদটি আরো গভীর। পাকিস্তান খন্ডিত হলেও একাত্তরের দুর্বলতা তারা বহুলাংশে কাটিয়ে উঠিয়েছে এবং টিকে আছে পারমাণবিক বোমা ও শক্তিশালী সামরিক শক্তি নিয়ে। হাজার হাজার লড়াকু মোজাহিদ সৃষ্টি করতে পারে এমন ইসলামী দর্শনের বলও সেখানে প্রবল। ফলে ভারতের পক্ষে এদেশটিকে নতজানু করা বা গিলে ফেলা এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একাত্তরে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে সাহস ভারতের আজ আর নেই। কিন্তু সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের অস্তিত্ব। কারণ, বাংলাদেশের হাতে সামরিক ও পারমাণবিক বল যেমন নেই, তেমনি দর্শনের বলও নাই। ইসলাম বাংলাদেশে লড়াকু মোজাহিদ সৃষ্টি না করে লাখ লাখ তাবলীগি সৃষ্টি করছে। আগ্রহ বাড়াচ্ছে সুফীবাদে এবং বুদ্ধিজীবীরা খ্যাতি অর্জন করেছে ভারতের প্রতি নতজানু চরিত্রের কারণে। পাকিস্তানের মাত্র একটি সীমান্তে ভারত, আর বাংলাদেশের তিনটি সীমান্তে। সমগ্র স্থল সীমান্ত দিয়ে শুধু ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও মদই শুধু আসছে না, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক হামলাও চলছে।
মুসলিমবিরোধী নাশকতাই যেখানে নীতি : ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে বাঙালি হিন্দুদের মাঝে রেনেসাঁ এসেছিল। সে সাথে বেড়েছিল মুসলমানবিরোধী নাশকতাও। এটিই হিন্দুদের রাজনীতির স্থায়ী লক্ষ্য। মুসলমানদের কল্যাণ ভারতীয় হিন্দুগণ ১৯০৫ সালে যেমন চায়নি, তেমনি ১৯৪৭-এ এবং ১৯৭১-এও চায়নি। কল্যাণ চাইলে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তি কেন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে মিছিল করবেন? ভারতীয় হিন্দুদের রাজনীতি পরিচালিত হয়েছে নিছক হিন্দু স্বার্থ ষোলকলায় পূর্ণ করার লক্ষ্যে এবং সেটি মুসলমানদের ক্ষতি করে। ১৯৪৭ সালে মুসলমানগণ বাংলার বিভক্তকরণ চায়নি, তারা চেয়েছিল অখন্ড বাংলা। কিন্তু সেদিন বাংলার বিভক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটি কলকাতা শহরসহ বাংলার বিশাল অংশকে ভারতভুক্ত করার লক্ষ্যে। অথচ তারাই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল ১৯০৫ সালে। ১৯০৫ সালে ভঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করার কারণ, তাতে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কল্যাণের সম্ভাবনা দেখেছিল।
মুসলমানদের প্রতি ভারত সরকারের মনোভাবটি যে কীরূপ সেটি সে দেশের শতকরা ১৫ ভাগ মুসলমানকে প্রশাসনে শতকরা ৩ ভাগের কম চাকরি, মসজিদ ধ্বংস, মুসলিম বিরোধী ঘন ঘন দাঙ্গা, দাঙ্গাকালে মুসলিম গৃহে অগ্নিসংযোগ এবং মুসলিম রমণীদের ধর্ষণের মধ্যদিয়ে কি প্রকাশ পায় না? বাংলাদেশের প্রতি তাদের কি মনোভাব সেটিও কি তারা গোপন রেখেছে? মনের গোপন মোটিভটি কখনই গোপন থাকে না, আচরণ ও কর্মের মধ্য দিয়ে সিটি প্রকাশ পায়। একাত্তরে ভারতের মূল লক্ষ্যটি কখনোই স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের নির্মাণ ছিল না, বরং সেটি ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের শক্তিহীন করা এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শক্তিরূপে হিন্দু শক্তির উত্থান। একাত্তরে যুদ্ধজয়ের পর ভারত সেটি প্রমাণ করেছে। ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধটি ঢাল-তলোয়ারের ছিল না। দীর্ঘমেয়াদী এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পাকিস্তান বহু হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র জমা করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এবং তার বেশির ভাগই সে যুদ্ধে অব্যবহৃত ছিল। পূর্ব-পাকিস্তানীরা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, অতএব সে অস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় হয়েছিল তাদের অর্থ। ফলে অস্ত্রের উপর মালিকানা ছিল তাদের। কিন্তু ভারত সে অস্ত্রের উপর বাংলাদেশের মালিকানা দেয়নি। তারা সমুদয় অস্ত্র ভারতে নিয়ে যায়।
ভারত বলে, একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ড একত্রে কাজ করেছিল। কিন্তু কোথায় সে যৌথ কমান্ড? যৌথ কমান্ড থাকলে পাকিস্তানী অস্ত্র ভারতে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ভারত একা নেয় কি করে? বরং নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণে মুক্তিবাহিনীকে তারা ব্যবহার করেছিল মাত্র। ভারতের লক্ষ্য, সামরিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে চিরতরে পঙ্গু রাখা।  এমন একটি লক্ষ্য নিয়েই পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত যুদ্ধাস্ত্র ভারত বাংলাদেশকে দেয়নি। শুধু যুদ্ধাস্ত্র লুণ্ঠনে নয়, ভারত তার বিবেকহীনতার প্রমাণ রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি লুণ্ঠনের মধ্য দিয়েও। ভারতীয় সে লুণ্ঠনের ফলেই ১৯৭৪-এ নেমে এসেছিল ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এবং তাতে মারা পড়েছিল বহু লাখ মানুষ। বিবেকহীনতার আরো প্রমাণ, ফারাক্কাবাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, বেরুবাড়ি দখল ও তালপট্টি দখল এবং বাংলাদেশের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো কি বন্ধুত্বের লক্ষণ, এরূপ কাজ একমাত্র প্রতিবেশী শত্রু দেশই করতে পারে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন এক শত্রুসুলভ চেতনা নিয়ে ভারত কি বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে?
সাংস্কৃতিক দখলদারি : পতিতাপল্লি, ডাকাতপাড়া বা বাঘ-ভালুক কবলিত জঙ্গলের পাশে বসবাসের বিপদ অনেক। পতিতাপল্লির সংস্কৃতি যেমন প্রতিবেশীকে পাপের দিকে ডাকে, তেমনি বনের হিংস্র পশুও প্রতিবেশীর প্রাণনাশের সম্ভাবনা বাড়ায়। অনুরূপ বিপদ আগ্রাসী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে বসবাস করাতেও। সেখানে ভয় যেমন স্বাধীনতা হারানোর, তেমনি ধর্ম ও সংস্কৃতি হারানোর। দুর্বলদের প্রতি হানাদার হিংস্রপশুর করণা থাকে না, তাদের ক্ষুধার্ত পেটে দুর্বলদের ঢুকাই নিয়ম। তেমনি দুর্বল প্রতিবেশীর প্রতি দরদ থাকে না আগ্রাসী প্রতিবেশীর। কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, জুনাগড়, মানভাদর ও সিকিমের ন্যায় দুর্বল দেশগুলো তাই ভারত থেকে কোনরূপ করুণা পায়নি, বরং এদেশগুলো হারিয়ে গেছে দেশটির আগ্রাসী পেটে। একই কারণে একাত্তরের পর কোনরূপ করুণা পায়নি বাংলাদেশ। স্বাধীন রূপে বাঁচতে হলে ইতিহাসের এ শিক্ষাটি জরুরি। নইলে স্বাধীনতা বাঁচে না। নিজ ধর্ম নিয়ে বেড়ে উঠার সংস্কৃতিও বাঁচে না।
অমুসলিম দেশে মুসলমানের বসবাস যত অধিকই হোক, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেখানে যা বাড়ানো হয় সেটি ইসলাম নয়, বরং গোমরাহি তথা পথভ্রষ্টতা। পথভ্রষ্টতাই সেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি। ভারতে সেটিই ঘটছে। অমুসলিম দেদেশ বসবাসের মূল বিপদটি এখানেই। বিপদ বেড়েছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি ভৌগলিক সীমানার সাথে একটি সাংস্কৃতিক সীমান্তও ছিল। সে সীমান্ত ভারতীয় পণ্যের ন্যায় ভারতের সাংস্কৃতিক পণ্যের অনুপ্রবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু একাত্তরে সাংস্কৃতিক সীমান্ত বিলুপ্ত হওয়ার পর কূল উপচানো প্লাবনের ন্যায় সাংস্কৃতিক পণ্যপসারিরা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। আসছে বই ও সিনেমা, আসছে গায়ক-গায়িকা ও নর্তকী, আসছে পত্র-পত্রিকা ও টিভি প্রচারণা। বাংলাদেশীদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদটি মূলত এখানেই। ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার চেয়েও এটি ভয়ানক। কারণ এখানে বিপদ ঈমান হারানোর এবং সে সাথে পরকালে জান্নাত হারানোর। সে কান্ডজ্ঞানটুকু আছে বলেই জনসংখ্যায় বাংলাদেশের সমান হয়েও সীমান্তের সুরক্ষা বাড়াতে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে জনসংখ্যায় সাত ভাগের এক ভাগ হয়েও তিরিশ বছর যাবত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে আফগান জনতা।
কোন কিছুই এ পৃথিবীতে বিনামূল্যে মেলে না। স্বাধীনতা তো নয়ই। ভারতের ন্যায় আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ থেকে স্বাধীনতা তাই উপহার রূপে পাওয়ার বিষয় নয়। স্বাধীনতা অর্জনে অর্থ, শ্রম ও রক্ত ব্যয়ের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক বল চাই। সেরূপ কোরবানী ও বল চাই স্বাধীনভাবে টিকে থাকার জন্যও। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কান্ডজ্ঞান নজরে পড়ে না। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বরে যে ঘটনাটি মানব ইতিহাসে প্রধান ঘটনা রূপে ঘটেছিল সেটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় নয়, বরং ভারতীয় বাহিনীর বিজয়। এবং ভারতের সে বিজয়টি উৎসবে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু ভারতের বিজয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে এক জিনিস নয় সে বোধটুকুই ক'জনের? রাজনীতি হচ্ছে আগ্রাসী ভারতের প্রতি নতজানু কৃতজ্ঞতা নিয়ে। এমন আত্মসমর্পিত চেতনা নিয়ে কি স্বাধীনতা বাঁচে?
১৯৭১-এ বহু হাজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকেছিল। আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২-এ ভারত সে সৈন্য তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দেশের আনাচে কানাচে সমাবেশ ঘটিয়েছে হাজার হাজার সাংস্কৃতিক সৈন্য। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে বহু লাখ সেক্যুলার এনজিও কর্মী। দিন দিন তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে ১৯৭২-এ তাদের সামরিক দখলদারি শেষ হলেও সাংস্কৃতিক দখলদারি শেষ হয়নি। বরং বিপুলভাবে বেড়েছে। অথচ সরকারের ও নাগরিকদের দায়িত্ব শুধু দেশের ভৌগোলিক সীমান্ত পাহারা দেয়া নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের চেতনা-রাজ্য পাহারা দেয়াও। সেটি সুস্থ ঈমান-আক্বিদা নিয়ে নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বার্থে।
ভৌগোলিক সীমান্ত পাহারায় অবহেলা হলে অধিকৃত হয় দেশ, তখন আসে রাজনৈতিক পরাজয় ও গোলামী। এমন অধিকৃত দেশে জনগণের রাজস্বের অর্থ ব্যয় হয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে। চেতনা রাজ্যে তখন দখলদারি বাড়ে শয়তানী শক্তির। বৃটিশ শাসনামলে তো সেটিই হয়েছিল। নমরুদ, ফিরাউনগণতো এভাবেই দেশ-দখলের সাথে সাথে মানুষের মনের রাজ্যও দখল করেছিল এবং নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ভগবানরূপে। একইভাবে মুসলিম দেশে নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছে সেক্যুলারিস্টগণ। এদের কারণে জনগণ শুধু ইসলাম থেকেই দূরে সরেনি, বরং আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিতে। সে বিদ্রোহকে ব্যাপকতর ও দীর্ঘজীবী করার স্বার্থেই পুঁজিবাদী, সমাজবাদী ও জাতি পূজারীরা ইসলামের সনাতন শিক্ষার প্রচারকে নিষিদ্ধ করে। কারণ সে সনাতন ইসলামে যেমন জিহাদ আছে, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার উপর বাধ্যবাধকতাও আছে। বাংলাদেশের আওয়ামী বাকশালী সরকার তাই দেশে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করছে। মুজিব নিষিদ্ধ করেছিল সকল ইসলামী দল। একই উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বহুদেশ নিষিদ্ধ করেছে মিসরের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব শহীদের বই। এবং কম্যুনিস্ট শাসনামলে সোভিয়েত রাশিয়া হাজার হাজার মসজিদ-মাদরাসাকে ঘোড়ার খোয়ার বানিয়েছিল এবং নিষিদ্ধ করেছিল কোরআনচর্চা।
ঘরের শত্রু : সাংস্কৃতিক সীমান্ত বিলুপ্তির ফলে ভারতীয় টিভি সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশীদের বেডরুমে সরবে ও সশরীরে কথা বলার। সাংস্কৃতিক সীমান্ত বলে বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত আছে, এবং সেটির প্রহরারও যে প্রয়োজন রয়েছে সে হুশটিও সরকারের নেই। কারণ একটাই। আর তা হলো বাংলাদেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ ভারতীয়দের থেকে এক ভিন্ন ভূগোলে বাস করলেও তাদের চেতনার বা আদর্শের ভূগোলটি এক ও অভিন্ন। সে ভূগোলে কোন সীমান্ত নেই, ফলে প্রহরাও নাই। পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি আর বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তারা এক অভিন্ন মনে করে। তেমন এক অভিন্ন সংস্কৃতির ধারণা নিয়েই তারা কবি রবীন্দ্রনাথের গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বানিয়েছে। এভাবে বাংলাদেশের সরকার ও সংস্কৃতির উপর যাদের দখলদারি তারা পরিণত হয়েছে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ারে। এরাই বাংলাদেশের ঘরের শত্রু।
বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের অভিযোগ : ১৯৪৭ সালে ভারতের সাথে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সাথে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনটি গড়া হয়েছিল নিছক সাম্প্রদায়িক চেতনায়। তারা পাকিস্তানের মানচিত্রে যেমন সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পায়, তেমন গন্ধ পায় পাকিস্তানসৃষ্ট বাংলাদেশের মানচিত্রের মাঝেও। দেশের আওয়ামী-বাকশালীগণ নিজেদেরকে এরূপ সাম্প্রদায়িক চেতনার ঊর্ধ্বে মনে করে, ফলে পাকিস্তানের গড়া বাংলাদেশের ১৯৪৭ সালে ভৌগোলিক মানচিত্র তাদের কাছে বেমানান মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত বিলুপ্ত করতে পারছে না স্রেফ জনগণের ভয়ে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের চেতনায় ভারতসেবী বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের ন্যায় ইসলামী চেতনা বিলুপ্ত হয়নি, ফলে মারা পড়েনি ১৯৪৭য়ে ভারত-বিভক্তির যৌক্তিকতার ধারণাটিও। জনগণের মনে সে চেতনাটি প্রবলভাবে বেঁচে আছে বলেই বেরুবাড়ী ও তালপট্টির উপর ভারতীয় দখলদারি, ফারাক্কা ও টিপাইমুখ বাঁধ এবং বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়।
আওয়ামী-বাকশালীগণ জানে, ভারতের সাথে সীমান্ত বিলুপ্ত হলে তাদের ঝামেলাটি কমবে। বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রাজনৈতিক শত্রুদের শায়েস্তা করার দায়ভারটি তখন সরাসরি ভারত নিয়ে নেবে। ফলে তাদের দমনে কোন বেগ পেতে হবে না। যেমনটি পেতে হয় না কাশ্মীরের ভারতসেবী ফারুক আব্দুল্লাহকে। ভারতবিরোধীদের শায়েস্তা করতে কাম্মীরের শ্রীনগর, বারামোল্লা, আনন্দনাগ, জম্মুর মত নগরগুলির রাজপথে, এমনকি নিভৃত পল্লীতে মোতায়েন করা হয়েছে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, বিহার ও অন্যান্য ভারতীয় প্রদেশ থেকে নেয়া ৬ লাখের বেশি সৈন্য। বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্র বিলুপ্ত হলে ঢাকার রাজপথেও তখন ভারতীয় সৈন্য শোভা পেত। ফারুক আব্দুল্লাহর মত শেখ হাসিনাও তখন নিরাপদে আজীবন গদীতে থাকতে পারতেন। নির্বাচনী জয়ের মত ঝামেলা তাকে পোহাতে হতো না, সেটি সুচারুভাবে সামাল দিত ভারত। কিন্তু অখন্ড ভারত নির্মাণের সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশের মুসলিম মানস থেকে ইসলামী চেতনার বিলুপ্তি জরুরি। তখন বিলুপ্ত হবে বাংলাদেশের আদর্শিক মানচিত্র। ভারত এবং ভারতপন্থী বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা জানে, বাংলাদেশের ভূগোল পরিবর্তনের মূল বাধাটি আসবে ইসলামী চেতনাধারীদের থেকে। ভারতের যে কোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকে তারা জিহাদে পরিণত করবে। ভারত সে প্রতিবাদী চেতনার বিলুপ্তি চায়। সে লক্ষ্যেই দখলদারি জমিয়েছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের মিডিয়া, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদৈর মাঝে ভারতসেবী মনোভাব তো সে দখলদারিরই প্রমাণ। বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে করিডোর বা টিপাইমুখ বাঁধের পক্ষে সমর্থন দিয়েও এরা লজ্জাবোধ করে না। তারা সোচ্চার শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যে কতটা বিপন্ন সেটি কি এরপরও বুঝতে বাকি থাকে?